খাদেম মানে নাকি সেবক!!

৩৬০ আউলিয়ার দেশ বাংলাদেশ ইতিহাস বলে  এদেশে আউলিয়াদের যাত্রা শুরু হয়েছিল পূণ্যভূমি সিলেট থেকে। আর তাদের নেতৃত্বে ছিলেন হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি।ইসলাম প্রচারে আউলিয়ারা  ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। শাহজালাল এর ওফাতের পর গড়ে ওঠে মাজার শরীফ। তৈরি হয় কোটি কোটি মুসলমান ভক্ত। তাই শত শত বছর পরেও শাহজালাল বেঁচে আছেন,বেঁচে থাকবেন ভক্তদের হৃদয়ে।

শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি এর মাজার শরীফ
শাহজালাল (রা) মাজার শরীফ


 আর আমরা জানি শাহজালাল রহমাতুল্লাহ আলাইহির মাজার থেকে ১০কিলোমিটার দূরে হযরত শাহপরান রাহমাতুল্লাহ আলাইহি মাজার শরীফ ।ইসলাম প্রচারে হযরত শাহপরান রাহমাতুল্লাহ আলাইহি এর অবদান অনেক।

শাহপরান রহমতুল্লাহি আলাইহির মাজার শরীফ
শাহপরান(রাহ) মাজার শরীফ

আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমি আমার ব্লগে কেন এই মাজার শরীফ নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি? শেষপর্যন্ত পড়ুন বুঝতে পারবেন মাজারকে ঘিরে কত রকম রমরমা ব্যবসা গড়ে উঠছে এখন। 

"মাজার" যেখানে মানুষ প্রতিদিন হাজির হয় গভীর বিশ্বাস নিয়ে,আবার কেউ কেউ সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে গড়ে তুলে লুটপাটের রাজত্ব। জি এখনোই চমকাবেন না! মানুষ প্রতিদিন এখানে আসে আর তাদের মানতের জিনিস তারা সেখান দিয়ে যায়। আর সেই মানতের জিনিসই নাকি সন্ধ্যা হতে না হতেই বিক্রি করে দেয়া হয়। বিক্রি কৃত টাকা চলে যাই মাজারের সেবকদের পকেট এ। মাজারের কর্নারে একপাশে রাখা হয়েছে সেই ছাগলগুলোকে। আমি আর আমার বন্ধু মিলে আসল রহস্য খোঁজার জন্য দাম কষাকষি শুরু করলাম ওইখানের দুজনের সাথে ,যারা দাঁড়িয়েছিল ছাগলগুলো নিয়ে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না ছাগল কিনা তারপরও আমরা ওদেরকে বললাম আমরা একটু পরে আসছি আমাদের কাছে এখন টাকা নেই। ওরা বললো আচ্ছা ভাই কোন সমস্যা নাই এরকম প্রতিদিনই ছাগল আসে আমরা প্রতিদিনই বিক্রি করি। এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এলো । হাসিমুখে আমরা সেখান থেকে সরে পড়লাম তখনই আমার বন্ধু তুষার তানভীর সে আমায় বলল চল ফলো করে দেখি ছাগল গুলো কোথায় যায়। আমরা ওদের পিছু নিলাম মাজোরিটি পিছন দিকে বের হলে ওরা এবং ছাগলগুলো নিয়ে ঢুকে পড়ল এক আলিশান বাড়িতে। আমাদের মনেও প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি দিতেই থাকে তাই রহস্য উদঘাটনে পরদিন আমরা আবার শাহজালালের মাজারে ।এবার আমরা দেখতে পেলাম সেখানে বসে আছেন মাজারের খাদেম যারা নাকি বংশপরম্পরায় খাদিম গিরি করে আসছেন। ভক্তদের দেয়া টাকা পয়সা জিনিসপত্র সব দেখভাল  করেন এ খাদেমরা ।তাহলে ভক্তদের  দেওয়া এত টাকা-পয়সা যায় কোথায়? 

রাত ৯ টায় হঠাৎ করে দেখলাম মাজারে রাখা ড্যাগ  গুলো থেকে সব টাকা-পয়সা নেয়ার জন্য কিছু লোক আসছে এবং তারা তাদের লাল কাপড়ে মুড়িয়ে টাকাগুলো কে নিয়ে রুমের দিকে রওয়ানা করল। অবাক হয়ে আমরাও পিছু নিলাম তাদের কিন্তু তারা একটি রুমে ঢোকার পর দরজা বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু মাজার পরিচালনা ও মাজারের বিভিন্ন কাজের জন্য  ওয়াক্‌ফ প্রশাসন  খরচ বহন করে আসছে। এবং ২০০৯ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় যেখানে বলা হয় মাজারে থাকা বক্সগুলোর চাবি থাকবে জেলা প্রশাসকের কাছে। কিন্তু মাজারের খাদেমরা হাইকোর্টে মামলা করে সেই নীতিমালাকে উচ্ছেদ করে দিয়ে তাদের কাছে আবার বক্সের চাবি নিয়ে আসে। তারপরও ওয়াকফো  প্রশাসন আবার হাইকোর্টের রিট করে বসে কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে সেটি এখনো পড়ে রয়েছে।

এবার চোখ দেয়া যাক শাহপরান মাজারের দিকে দুটো মাজারকে ঘিরে লাখো মানুষের বিশ্বাস, আছে রাজনৈতিক কিছু ঐতিহ্য কিন্তু তাই বলে বিশ্বাস আর ঐতিহ্যকে পুঁজি করে খাদেমরা যখন দিনের পর দিন অনিয়ম করে যায় যা চোখে পড়লে ও কথা বলার মত কাউকে পাওয়া যায় না। শাহপরান মাজারের ঢুকতেই আপনার একটি গদিঘর দেখতে পাবেন যেখানে প্রতিনিয়ত টাকা তোলা হয় ।মাজারের বাইরে থাকা একজনের কাছ থেকে জানতে পারি শাহপরান মাজারের খাদেম আছেন ২৯জন। প্রতি তিন দিন পর পর একজন খাদেম মাজারের গদিতে বসেন। দায়িত্ব তাকে পুরো মাজার দেখভাল করার এই নিয়ম কবে থেকে চালু হয়েছে তা সঠিক কারো জানা নেই তবে আমাদের গ্রামের এক চাচার কাছ থেকে জানতে পারি উনি বলেছিলেন এই নিয়ম নাকি শুরু হয়েছিল প্রায় ১৯৭৫ সাল থেকে।আমার মনে প্রশ্ন জাগে কত টাকা উঠে প্রতিদিন মাজারে আর বছরে বা কত টাকা আসে এই মাজার শরীফে। কত টাকা খরচ করা হয় মাজার এর পিছনে ?কোন উন্নয়ন তো চোখে পড়ছে না বেশ কয়েকবছর ধরেই তাহলে এত টাকা যায় কই?

এবার অনেক খুজাখুজির পর অনলাইনে খুঁজে পাওয়া গেল ওয়াক্‌ফ প্রশাসনের ২০০৯সালে একটি প্রতিবেদন।যাতে লেখা আছে প্রতিদিন জেয়ারত বাবদ জমা পড়ে এক লাখ টাকা প্রতি শুক্রবারে উঠে ৩ লক্ষ, শবে বরাতের রাতে প্রায় ২০ লাখ এবং শবে কদরের প্রায়১৫ লাখ টাকা, সবমিলিয়ে বছরে প্রায় ৬কোটি টাকা আসে ভক্তদের কাছ থেকে। ওয়াক্‌ফ এর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই আইয়ের ৬২ শতাংশ খরচ হবে মাজারের উন্নয়নের কাজে ।এই নিয়ম কি মানেন খাদেমরা? ২০১৮ সালে ওয়াক্‌ফ একটি বক্তব্য থেকে জানা যায় মাজারের প্রত্যেকটি উন্নয়নমূলক কাজে সরকার অনুমোদিত টাকা দেয়া হয় যেমন রাস্তাঘাট মহিলার জন্য দস্তরখানা এবং মাজারের পাশে তিন তালা একটি ভবন। তাহলে জমাকৃত টাকা যাই কোথায় ?সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়! জানার কথা সেইসব খাদেমদের যারা এর ব্যবস্থাপনায় আছেন। তাহলে কি আপনাদের বুঝতে বাকি মারপ্যাঁচ টা কোথায়??

চলুন তাহলে আরেকটু ভেতরে ঢুকা যাক। অনেকেই এখানে জিয়ারত করতে এসে আগরবাতি মোমবাতি কুরআন শরিফ, ইসলামিক বই, সুগন্ধি ইত্যাদি সামগ্রী কিনে মাজারের দান করে যান। দেখা যাক তাহলে সেগুলো কোথায় যায় ?মাজার কমপ্লেক্সের ভিতরে আছে ৩৬ টি দোকান এগুলোর মধ্যে ১৩ টি মাজারের খাদেম দের। ওয়াক্‌ফ থেকে ১৬ টি অনুমতি থাকলেও বাকি গুলোর কোন অনুমতি নেই। এগুলির মধ্যে মোমবাতি তাবিজ লাল সুতো কুরআন ইসলামিক বই সুগন্ধি পাওয়া যায় , তবে মোমবাতি আগরবাতি গোলাপজল ও সুগন্ধির বেচাকেনা বেশি। আর দিন শেষে এ পণ্যগুলো আবারো চলে আসে সেই তেরোটি খাদেমদের দোকানে! পণ্য গুলো আবার বিক্রি হয় ,আবারও রাতে চলে আসে দোকানে। এভাবেই চলছে লুটপাটের রাজত্ব ।কিন্তু বলা আছে ওয়াকফে আইনে মাজারে উঠা টাকার ছয় আনা অর্থাৎ ৩২ শতাংশ খরচ হবে মুসাফিরদের জন্যে যারা দূর-দূরান্ত থেকে মাজার জিয়ারত করতে আসেন। আজও আমরা দেখতে পাইনি দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসাফিরদের জন্য আরাম-আয়েশের  কোন ব্যবস্থা। তাহলে কি তদন্ত হচ্ছে না এ ব্যাপারে? না ।শুনেছিলাম তদন্ত হয়েছে ,তদন্ত হয়েছে নাকি এগারোবার প্রত্যেকবারই উঠে এসেছে মোতাওয়াল্লী সহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি তারপরও কিভাবে সেই মোতাওয়াল্লী সহ বাকি  ২৯ জন দিনের পর দিন অনিয়ম আর দুর্নীতি করার পরও তাদের অবস্থায় বহাল থাকতে পারে। প্রশ্ন রইল আপনাদের কাছে? লাখো ভক্ত আসছে দান করছে আবার চলছে রাজনীতিবিদদের ঐতিহ্যগতভাবে মাজার জিয়ারত করে তাদের কার্যক্রম শুরু করছেন এগুলো কি স্বাভাবিকতার লক্ষণ তাহলে ওয়াক্‌ফ প্রশাসন যে এতদিন ধরে এতবার তদন্ত করে তদন্ত করে অনিয়ম আর দুর্নীতির চিত্র তুলে আনল সেগুলোর কি হবে ? তবে কি লাখো মানুষের বিশ্বাস আর আর সরকার ও বন্দী হয়ে থাকবে এসব খাদেমদের হাতে এ প্রশ্ন রেখেই শেষ করলাম আজকের ব্লগ।

লেখক: ব্লগার,রেজাউল হক।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সিলেটি ভাষা ও সংস্কৃতি

নতুন সমাজ ব্যবস্থায় হাটছি আমরা

প্রসঙ্গ: ধর্মওয়ালা শাসক শোষক বনাম অভিজিৎ