সিলেটের বহুল পরিচিত শব্দ"খোজকর" নিয়ে কিছু কথা

বাংলা অভিধানে ‘খোজকর’ শব্দের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না।এমনকি বৃহত্তর সিলেটের বাইরে কোথাও এর অস্তিত্ব আছে কি না সে ব্যাপারেও সন্দেহ আছে।সিলেটেও বর্তমানে এটি একটি মৃত শব্দ। শ্রীযুত অচ্যুৎ চৌধুরী প্রণীত ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ নামক সুবিশাল গ্রন্থে কয়েক লাইনে খোজকর শব্দের উল্লেখ থাকলেও প্রথমেই সেখানে তার ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। গ্রন্থমতে ফালজোড়ের কালী সদনে এক সময় নরবলির প্রচলন ছিল। শারদীয় পূজার নবমী তিথীতে অথবা জয়ন্তিয়া রাজকুমারদের জন্মাদি অনুষ্টান উপলক্ষে নরবলি দেয়া হতো। চরগণ অন্যান্য রাজ্য থেকে বলির জন্য মনুষ্য সংগ্রহ করত আর এই চরদেরই বলা হতো খোজকর ১।বলিদানের তথ্য সঠিক হলেও খোজকর নামকরণের তথ্য সঠিক নয় কারণ নরবলির জন্য মনুষ্য সংগ্রহকারীদের নাম খোজকর হওয়ার কোনো কারণ নেই। খোছকর বা খোজকর শব্দটি গঠিত হয়েছে ফার্সী খোজা ও বাংলা কর প্রত্যয় যোগে।খোজা মানে নপুংশক এবং এর সাথে কর প্রত্যয়যোগে হয়েছে খোজাকর<খোজকর<খোছকর। তারমানে খোজকর শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কৃত্রিম উপায়ে খোজা বা নপুংশক বানানো।সিলেটে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী এই কুপ্রথাটি চালু ছিল।ছেলেধরা চক্র প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শিশুদের ধরে খোজা বানিয়ে বাইরে বিক্রি বা পাচার করে দিত।খোজাকরণের সাথে নরবলির সম্পর্ক হয় কী করে? অবশ্য মনুষ্য বেচাকেনা বা মনুষ্য পাচারের একটি প্রাচীন রুট ছিল সিলেট এলাকা।সুতরাং ছেলেধরা পেশাটিও সিলেটে সুপ্রচলিত ছিল।একারণে বলি, পাচার বা খোজা বানানোর জন্য সকল অপহরনকারীই এক খোজকর নামে অভিহিত হওয়া অস্বাভাবিক ছিলনা।অবশ্য ফুটনোটে ইতিবৃত্তের গ্রন্থকার ‘হয়তো’ শব্দ দিয়ে প্রায় সঠিক তথ্যই দিয়েছেন। ২


সিলেটে খোজকর প্রথার উৎপত্তি প্রসঙ্গে আলোচনার আগে খোজাদের ইতিহাস বিষয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত প্রয়োজন। বাইবেলের ম্যাথু অধ্যায়ের বর্ণনা মতে “For there are some eunuchs, which were so born from their mother’s womb: and there are some eunuchs, which were made eunuchs of men: and there be eunuchs, which have made themselves eunuchs for the kingdom of heaven’s sake”৩ বাইবেলের এই উক্তি থেকেই প্রমানিত হয় নপুংশক বা খোজাকরণের ঘৃণ্য প্রথাটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন।শেষোক্ত ধর্মীয় কুসংস্কার বশতঃ স্বেচ্ছায় নপুংসক হওয়ার নজির একাদশ শতকের খৃষ্টান স্কপ্টসি (Skoptsy) সম্প্রয়াদায় যারা জাগতিক কামনা বাসনাকে বিসর্জন কল্পে স্বেচ্ছায় নিজেদের লিঙ্গচ্ছেদ করে খোজাতে পরিনত হতো।তৎকালীন সময়ে এদের সংখ্যাটিও উল্লেখ করার মতো।প্রায় লক্ষাধিক সদস্য এই দলভুক্ত ছিল। আর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের বা নিজেদের হীন স্বার্থে কাউকে খোজা বানানোর প্রথম ঘটনা ঘটে প্রাচীন মেসিপ্টোমিয়ায়। আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রানী সেমিরামিস (খৃঃপূর্ব ৮১১-৮০৮)প্রথমবারের মতো একটি বালকের লিঙ্গ ছেদন করে এই ঘৃণ্য প্রথার সূত্রপাত করেন।৪


খোজা করণের অমানবিক পদ্ধতি


একটি শিশু যে একটি বিশেষ লিঙ্গের অধিকারী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে তাকে মানুষের বিকৃত মানসিকতার বা ক্ষুধার খোরাক বানাতে যে সার্জারির মাধ্যমে বদলে ফেলা হতো কেমন ছিল সেই পদ্ধতি? এ বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ আছে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক Barbara Chase-Riboud এর লেখা ‘Valide; novel of Harem উপন্যাসে।৫


বারবারার বর্ণনা মতে-প্রথমে বালক বা কিশোরকে হেলান অবস্থায় বসিয়ে তলপেঠ ও উরোর উপরি অংশে ফিতা দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে দেয়া হতো যাতে অধিক রক্তক্ষরণ না হয়।তারপর লিঙ্গ এবং অন্ডকোষকে তিনবার ঝাল মরিচ গোলা পানি দিয়ে ধুয়া হতো।সম্ভবতঃ এনেস্থেসিয়ার বিকল্প হিসেবে এটি করা হতো।মরিচ গোলা পানিতে অঙ্গ ধৌতকরণের কারণে প্রচন্ড ঝালা হতো এবং এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাতেই একটি বাঁকানো চাকু দিয়ে লিঙ্গ এবং অন্ডকোষকে যথা সম্ভব চামড়ার সাথে লাগিয়ে কেটে ফেলা হতো।প্রস্রাব নালীতে একটি ধাতব কাঠি ( আমাদের দেশে নিমের চিকন ডাল ) প্রবেশ করিয়ে কাটা অঙ্গকে ঠান্ডা পানিতে ভিজানো কাগজ দিয়ে ঢেকে সতর্কভাবে ব্যান্ডেজ করা হতো। ব্যান্ডেজের পর দুইজন হাজামের সাহায্যে আক্রান্তকে হাঁটিয়ে তার কক্ষে নেয়া হতো এবং দু’তিন ঘন্টা পর তাকে শুইয়ে দেয়া হতো। তিনদিন তাকে কিছুই পান করতে দেয়া হতোনা। একদিকে কাটা অঙ্গের যন্ত্রণা অপরদিকে বুক ফাঁটা তৃষ্ণা।এ ভাবেই তাকে তিল তিল করে দিনটি দিন অতিক্রম করতে হতো। তিনদিন পর ব্যান্ডেজ খুলে কাঠিটি বের করে আনার পর যদি ঝর্ণার মতো মূত্রধারা প্রবাহিত হতো তবেই অপারেশন সফল বলে গণ্য হতো আর মূত্র না বের হলে সেই হতভাগা শিশুটির অবধারিত পরিনাম ছিল মৃত্যু কারণ মূত্র বের না হওয়ার অর্থ তার কিডনী ডেমেজ হয়ে গেছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু কিশোরগণ কিডনী নষ্টের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো।


এই নির্দয় সার্জারি আর পৌরষত্ব হারানোর যন্ত্রণা ভুক্তভোগীকে কী রকম হিংস্র এবং প্রতিশোধ পরায়ন করে তুলতো Valide উপন্যাসে সে রকম একটি ঘটনার উল্লেখ আছে।বারবারা ঐতিহাসিক হেরোডিটাসকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করেছেন খৃষ্টপূর্ব ৪৮০-৮১ অব্দের দিকে প্যানোনিয়াস নামক এক ব্যক্তি হার্মোডিটাস নামের একটি বালককে জোরপূর্বক খোজা বানিয়ে বিক্রি করে দেয়। নিজের পৌরষত্ব হারানোর ক্ষোভ হার্মোডিটাসকে এতটাই প্রতিশোধপরায়ন করে তুলে যে পরবর্তীকালে যখন অনুকূল সময় আসে তখন তিনি প্যানোনিয়াস ও তার পরিবারকে অবরুদ্ধ করে প্যানোনিয়াসকে দিয়ে তার চার সন্তানকে খোজা বানাতে বাধ্য করেন। কিন্তু এতেও তার পূর্ণ পরিতৃপ্তি না হওয়াতে সন্তানদের দিয়ে প্যানোন্যাসকেও নপুংশক বানিয়ে প্রতিশোধের ষোলকলা পূর্ণ করেন।৬


খোজাদের বাণিজ্যিক ব্যবহার


খোজাকরণের পর একেবারে প্রথম থেকেই এসেরিও সাম্রাজ্যে এদেরকে প্রহরীর কাজে নিয়োজিত করা হয়। ভাগ্যের পরিহাস, যে বিকৃত মানসিকতার কারণে রানী সেমিরামিস এই প্রথার সূত্রপাত করেছিলেন তার জীবনাবসান হয় তারই সৃষ্ট এক খোজার হাতে।রাজ অন্তঃপুরী প্রহরার কাজে খোজাদের বিশ্বস্ততার সুখ্যাতির কারণে দেশে দেশে এদের চাহিদা দ্রুত বেড়ে যেতে থাকে। পারস্য মিশরে ফিনেশিয়, কার্তাজিনিয়ান গ্রীক ও রোমান শাসকগণ এই কাজে খোজাদের নিয়োগ দেন। চিওস ও ডিলস দ্বীপপুঞ্জ এবং ইপেসাস শহর খোজাদের জন্য খ্যাত ছিল।ইহুদি নবি ইয়াকুব পুত্র ইউসুফ মিশরে ফারাও সম্রাটের কারাগারে বন্দি অবস্থায় যে দুজন কারারক্ষীর সাক্ষাৎ পান এ দুজনই ছিলেন খোজা।পুতিপার নামক যে ব্যক্তি ইউসূফকে ক্রয় করেন তিনিও খোজা ছিলেন।রোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেও খোজাদের ব্যবহার ছিল।রাশিয়ার রাজকুমারীদের হেরেম প্রহরায়ও খোজারা নিয়োজিত ছিল। বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে তুর্কি অটোমানরা খোজাপ্রথা ধার করে। অটোমান সম্রাটদের হেরেম ছিল নারীতে পরিপূর্ণ সেই বিশাল সংখ্যক জেনানাকে পাহারা দেয়ার জন্য প্রচুর খোজার প্রয়োজন পড়ে আর এর পুরোটাই সরবরাহ করে বাইজেন্টাইনরা। সাধারনতঃ হেরেম প্রহরায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ খোজা ব্যবহার করা হতো।শ্বেতাঙ্গ খোজাদের হেরেমের খুব নিকঠে ভিড়তে দেয়া হতোনা এর কারণ এদের অনেকের লিঙ্গচ্ছেদন অসম্পূর্ণ থাকত এবং এদের সৌন্দর্যে হেরেমবাসিনীদের প্রবলভাবে আকর্ষিতা হবারও আশঙ্কা থেকে যেত। এ কাজে বরং নিগ্রো খোজাদের চাহিদা ছিল বেশী কারণ এদের চেহারা দেখে নারীরা কাছে ভিড়ার সাহস পেতনা এবং তূলনামুলকভাবে এরা বেশী বিশ্বস্ত ছিল। তথাপিও কিছুদিন পর পর হেরেমের ডাক্তার প্রতিটি খোজা প্রহরীকে পরীক্ষা করে দেখতেন তাদের নিম্নভাগে কোনো অবাঞ্চিত অঙ্গ গজিয়ে উঠল কি না। খোজাকরণ প্রক্রিয়াটি মুসলমানদের আবিষ্কার না হলেও এবং তাদের ধর্মীয় মতে প্রথাটিকে নিষিদ্ধ গণ্য করা হলেও মুসলমান শাসকরা একে ব্যাপকভাবে আত্নস্থ করেন।৭ এক সময় এটা শুধু হেরেম পাহারা দেয়াই মুখ্য উদ্দেশ্য না থেকে বরং যৌনাচারের এক বিকৃত কলায় পরিনত হয় এবং এ কাজে মুসলমান শাসকদের নানা কীর্তি কাহিনী ইতিহাস হয়ে আছে। এরা অস্বভাবিক যৌনাচারকে প্রাতিষ্টানিক রূপ দেন।খলিফা হারুন আল রশিদের সময়ে বাগদাদে অস্বভাবিক যৌনাচারকলা শিক্ষা দেয়ার জন্য গোলমান বা গিলম্যান ইনষ্টিটিউট পর্যন্ত প্রতিষ্টিত হয়।খলিফা আল-মামুনের শাসনামলে এক বিচারকের চারশত গোলমান থাকার কথা জানা যায়। এই গোলমানগণ প্রায় সকলেই খোজা হতেন।৮ আরব ও পারস্য দেশের কবিদের কবিতায় উঠে আসে এই সুন্দর বালকদের কথা। আবু নোয়াসের মতো কবি তার কবিতায় আরবদের বিকৃত আবেগকে ধারণ করতে দ্বিধা করেননি। এরাই ফার্সি রুবাইয়াতে বহুল উল্লেখিত সাকি। আমাদের কবি নজরুলও ফার্সি কবিদের অনুকরণে সাকি নিয়ে গান রচনা করেছেন ‘করুণ কেন অরুণ আখিঁ,দাওগো সাকি দাও শরাব’ অথবা ‘এ কোন মধুর শরাব দিলে আল আরাবি সাকি’ ইত্যাদি। অবশ্য এ স্থলে মনে হয় শরাব বলতে ইসলাম আর সাকি বলতে এর প্রবর্তককে বুঝানো হয়েছে।


ভারতবর্ষে মুসলমান ও তাদের বিকৃত সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ


মুসলমান শাসকদের আগমনের সাথে সাথে ভারতবর্ষেও এই কুখ্যাত প্রথার আমদানী ঘটে।“Along with their faith Islamic rulers brought their homo sexual customs, and as a result homosexual loves figured in the lives of some of the most prominent of the Islamic rulers of India.৯ আর এই বিখ্যাতদের মাঝ থেকে সর্ব প্রথমেই যে নামটির কথা উল্লেখ করতে হয় তিনি গজনীর সুলতান মাহমুদ।নজরুল তাঁর বিখ্যাত সাম্যবাদী কবিতায় এই মাহমুদকেই আহবান জানিয়েছিলেন-“কোথা চেঙ্গিস,গজনী মামুদ,কোথায় কালা পাহাড়” বলে।এই সুলতান মাহমুদের গোলমান আসক্তি ছিল বিষ্ময়কর।খোদাভীরু পরম ধার্মিক এই শাসকের মনোরঞ্জনের জন্য নিয়োজিত ছিল চার হাজার সুদর্শন তুর্কি কিশোর।তিনি যখন সিংহাসনে বসতেন তার বাম পাশে দাঁড়াতো দুহাজার গোলমান যাদের মাথায় থাকতো চার পালকযুক্ত টুপি হাতে সোনালী দন্ড ডান পাশে দাঁড়াতো দুহাজার কিশোর যাদের মাথায় থাকতো দুই পালক বিশিষ্ট টুপি এবং হাতে রুপালী দন্ড।জর্জিয়ান কিশোর মালিক আয়াজ এবং সুলতান মাহমুদের প্রেম কাহিনীতো সুফি সাহিত্যে অবিনশ্বর হয়ে আছে। তাদের প্রেমগাঁথা সেখানে আদর্শ প্রেমের নিদর্শন হিসেবে নন্দিত এবং বন্দিত।ফারসী কবি শেখ শাদি’র ‘বোঁস্তা’য়’ও এই প্রেমকাহিনীর উল্লেখ করা হয়েছে। পরম পরাক্রমশালী সুলতান মাহমুদ একদিন কৌতুকছলে আয়াজকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি কি আমার চেয়ে শক্তিশালী কোনো নৃপতির নাম জান ? আয়াজ বলেছিলেন আমিই আপনার চেয়ে শক্তিশালী সম্রাট। বিষ্মিত মাহমুদ জিগ্যেস করেছিলেন-কীভাবে? আয়াজ প্রতুত্তরের বলেছিলেন-আপনি পরক্রমশালী সম্রাট আপনার হৃদয় আপনাকে শাসন করে আর এই বান্দা আপনার হৃদয়ের শাসক।


ভারত বর্ষের ইতিহাসে খোজাদের প্রভাব বিষ্ময়কর।বিকৃত যৌনাচারে আসক্ত শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক খোজা রাষ্ট্রের শীর্ষপদে উঠে যান এমনকি শাসককে হত্যা করে শাসন ক্ষমতা দখলেরও দৃষ্টান্ত রয়েছে।আলাউদ্দিন খলজির গুজরাট অভিযানের সময় মালে গনিমত হিসেবে এক সুদর্শন বালক তার হাতে আসে যার রূপে খলজি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন।বালকটিকে তাৎক্ষণিক লিঙ্গকর্তনপূর্বক খোজা বানিয়ে তার যৌনসাথী বানানো হয়। মমতাজের প্রতি শাহজাহানের যেরকম ভালোবাসা ছিল সেই বালকের প্রতি আলাউদ্দিন খলজিরও সে রকম ভালোবাসা ছিল। বালকের প্রতি প্রেমের নিদর্শন হিসেবে তার নামাংকিত কবজ তিনি কোমরে বেঁধে রাখতেন। ধর্মান্তরিত করে এই বালকের নাম রাখা হয় মালিক কাফুর। তার প্রতি সুলতানের তূলনাবিহীন ভালোবাসার কারণে বালকের নাম হয় মালিক কাফুর হাজারদিনারী। মালিক কাফুর সারা জীবন সুলতানের পাশে থেকে তার মনোরঞ্জন করে গেছেন যদিও সুলতান অসুস্থ হয়ে প্রিয় দাসের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়লে কাফুর তাকে বিষপানে হত্যার চেষ্টা করেন।আলাউদ্দিন খলজির মৃত্যুর পর মুবারক খলজি ক্ষমতাসীন হয়ে পিতার পদাংক অনুসরণ করেই আরেক ধর্মান্তরিত সুদর্শন হিন্দু বালকের প্রেমে পড়েন। প্রথমে হাসান ও পরে খসরুখান নামে পরিচিত এই তরুণ তাকে এতই মোহাবিষ্ট করে ফেলে যে মোবারক সকল সুহৃদ আমির ওমরাহকে দূরে ঠেলে দিয়ে খসরুখানকে নিয়েই মেতে ওঠেন এমনকি খসরুখান দ্বারা প্ররোচিত হয়ে রাজ প্রাসাদের ফটকের চাবি পর্যন্ত খসরুখানের লোকের কাছে হস্তান্তর করেন। প্রতিশোধপরায়ন ও ক্ষমতালোভী খসরুখান এই সুযোগ নিয়ে একরাতে সুলতানের যৌন উন্মাদনার দুর্বলতম মুহুর্তে মোবারক খলজিকে হত্যা করেন এবং উন্মুক্ত ফটক দিয়ে তার অনুগত বাহিনী প্রাসাদে প্রবেশ করে হেরেমের সকল নারীকে গণ ধর্ষনের পর হত্যা করে। এভাবেই খসরু খান দিল্লীর সুলতানাত অধিকার করেন।১০


ইমাম উদ্দিন রায়হান ছিলেন সুলতান বলবনের প্রধানমন্ত্রী। জাহান মালিক নামক এক কৃষ্ণাঙ্গ খোজা সুলতান মাহমুদের উজির নিযুক্ত হন। ১৩৯৪ সালে তিনি মালিক উস সারক উপাধি নিয়ে জৈনপুরের গভর্নর নিযুক্ত হন। মোগল আমলে অনেক খোজা মনসবদার,কমান্ডার ও বিভিন্ন সুবার গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। খাজা সারাস বা প্রধান নাজির ইতিমাদ খান বা ইতবার খান নামে খেতাবপ্রাপ্ত হন। জাহাঙ্গীরের প্রধান খোজা ইতবার খান আগ্রার গভর্নর নিযুক্ত হন। ফিরোজ খান নামক আরেকজন খোজা ১৫০০/৬০০ সৈনিকের মনসব ছিলেন। বাখতাওয়ার খান ছিলেন খোজাদের সুপারিন্টেন্ডেন্ট। তিনি পন্ডিত ও ঐতিহাসিক ছিলেন।তিনি তারিখই আলফি’ ও ‘আকবার উল আখিয়ার’ এর সংক্ষিপ্তকরণ করেন এবং’মিরাত উল আলম’ বা ‘মিরাতই জাহান নামা’ রচনা করেন। মিয়া খোশফাহান, মিয়া আর্জমান্দ , মিয়া মহব্বত এই তিন বিখ্যাত খোজা (১৭৫৪-১৭৫৬) মোগলানী বেগমের পক্ষে সাম্রাজ্য শাসন করেন।



ফুল মালিক ওরফে খোজা ফুল থেকে ইতবার খান হয়ে ওঠা এক প্রভাবশালী বাঙ্গালী খোজার কথা।


বিভিন্ন দেশ ও জাতীয়তার অধিকারী শক্তিমান ও প্রভাবশালী খোজাদের মাঝে বাঙ্গালী হিসেবে যে খোজার নাম পাওয়া যায় তিনি ইতিবার খান বা খোজা ফুল ওরফে ফুল মালিক।তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে আগ্রার গভর্নর নিযুক্ত হন। কিন্তু তিনি নিষ্টুরতার জন্যেই ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি তার পৌরুষত্ব হারানোর ক্ষোভ কোনোদিনও বিষ্মৃত হতে পারেননি। ফুল তৎকালীন বাংলার কোথাও এক দরীদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন হয়তো বা বৃহত্তর সিলেটেরই কোনো এক অঞ্চলের সন্তান তিনি।কারণ সিলেটেই এই কুপ্রথাটি কয়েক শতাব্দী ব্যাপী চালু ছিল।এছাড়া ফুল নামটিও সিলেটে খুব জনপ্রিয়।ফুলকে দরীদ্র এবং লোভী মা বাবা ‘মালে ওয়াজিরির কাছে বিক্রি করে দেন।ফুলের পৌরষত্ব হারানোর অনুভূতি তার জীবনে কী রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা তার অপ্রকৃতস্থ জীবন চিত্র থেকেই প্রতিভাত হয়।ফুল যখন ইতিবার খান উপাধি নিয়ে আগ্রার গভর্নর তখন তার বৃদ্ধ বাবা মা ছেলের এই অসামান্য সফলতার খবর শুনে কিছুটা আর্থিক আনুকূল্যের প্রত্যাশায় বাংলা থেকে সুদূর আগ্রায় গিয়ে হাজির হন এবং অনেক চেষ্টা তদ্বির করে ইতিবার খানের সাক্ষাৎ লাভ করেন।কিন্তু ইতিবার খান মা বাবার পরিচয় পেয়ে আনন্দের বদলে ক্রুদ্ধ হয়ে এদেরকে পঞ্চাশটি করে বেত্রাঘাত করার জন্য দরবারের প্রহরীকে নির্দেশ দেন। তিনি দরবারে আবেগাপ্লুত ভাবে ঘোষণা করেন-যারা সামান্য কটি অর্থের বিনিময়ে তার জীবনের শ্রেষ্ট উপভোগের উপকরণকে বিক্রি করে দিতে পারেন তাদের জন্য এই হলো উত্তম পুরষ্কার। পরে দরবারে উপস্থিত ইটালিয়ান লেখক ও পর্যটক নিকোলাও মানোচির অনুরোধে তার এই আদেশ প্রত্যাহার করে তাদেরকে একশত টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয় এবং ইতিবার খান তাদের এই বলে হুশিয়ার করে দেন ভবিষ্যতে যদি তাদেরকে আবার এখানে দেখা যায় তবে তিনি নিজ হাতে তাদেরকে হত্যা করবেন। নিষ্টুরতার জন্য ইতিবার খান এতটাই কুখ্যাত হয়ে ওঠেন যে সম্রাট আওরঙ্গজেব আগ্রার দুর্গে বন্দি পিতা শাহজাহানকে শারিরীক ও মানসিক শাস্থিদানের জন্য ইতিবার খানকে নিয়োগ দেন। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমরা শৈশবে পাঠ্য বইয়ে পড়েছি তিনি ফকির বাদশাহ বলে খ্যাত ছিলেন। তিনি টুপি সেলাই করে ও কোরান নকল করে তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।এসব উপাখ্যান পড়ে যে এক মহানুভব সম্রাটের প্রতিচ্ছবি আমাদের মানসপটে স্থায়ী হয়ে আছে আসলে কি তিনি তাই? এই নিষ্টুর হৃদয় মানুষটি ক্ষমতার লোভে নিজ পিতা বাদশাহ শাহজাহানকে আগ্রা ফোর্টে বন্দি করে রেখে তাকে তিলে তিলে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দিতে ইতিবার খানের উপর দায়িত্ব দেন এবং ইতিবার খানও অতি বিশ্বস্ততার সাথে তার দায়িত্ব পালন করেন। আওরঙ্গজেব সহোদর অগ্রজ দার্শনিকতূল্য পন্ডিত দারা শিকোহকে ১৬৫৮ সালের ৩০ মে সামুগড়ের যুদ্ধে পরাজিত করে তার মাথা কেটে বাক্সে ভরে ইতিবার খানের মাধ্যমে পিতা শাহজাহানকে উপঢৌকন পাঠান। শাহজাহান যখন রাতের ডিনার খাবার জন্য টেবিলে আসেন তখনই ইতিবার খান বাক্সটি খুলে টেবিলে রাখেন। প্রিয়তম পুত্রের কর্তিত মাথা দেখে শাহজাহান চিৎকার করে টেবিলের উপরই মূর্ছা যান।সম্রাটের জ্ঞান ফিরে আসলে ইতিবার খান দারা শিকোহর চূল ও দাড়ি টেনে টেনে তুলতে থাকলে চূলের গোড়া থেকে তাজা রক্ত বেরোতে শুরু করে এই নিষ্টুর দৃশ্য দেখে শাহজাহান চিৎকার করে আর্তনাদ করতে থাকেন।ইতিবার খানের মুখ থেকে শাহজাহানের এই প্রতিক্রিয়ার বিবরণ শুনে আওরঙ্গজেব ও তার বোন রোশেনারা বেগম অতি আনন্দের সাথে তা উপভোগ করেন এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন।আওরঙ্গজেব ও ইতিবার খান পরামর্শ করে খাদ্যে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে নির্মমভাবে তাজমহলের অমর নির্মাতাকে হত্যা করেন।১১ বন্দী এবং অসহায় শাহজাহানের প্রতি খোজা ফুল যে অমানবিক নিষ্টুরতা দেখিয়েছেন তা কোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষের পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব। 




লেখক :ব্লগার,রেজাউল হক

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সিলেটি ভাষা ও সংস্কৃতি

নতুন সমাজ ব্যবস্থায় হাটছি আমরা

প্রসঙ্গ: ধর্মওয়ালা শাসক শোষক বনাম অভিজিৎ