রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কিছু কথা!

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে অনেক লেখা আছে, থাকবে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে নানা মানুষ লেখেন। লেখার কি শেষ আছে? রবীন্দ্রনাথকে মেলে ধরা সহজ কোন কাজ নয়। তবু তাঁকে জেনে বুঝে আর তাঁকে নিয়ে লিখতে চান এমন মানুষদেরও অভাব নেই। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কিছু লেখা হয়তো আমার ধৃষ্টতা হবে, তবু লিখছি। কিছু কিছু তথ্য হয়তো বা অনেকের মনে নেই বা তারা জানার আগ্রহ বোধ করেননি, তেমনি কিছু নিয়েই এ লেখা। সামান্য পড়াশোনা করতে হয়েছে এইটুকু লিখতে। ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে পূর্ব-বঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশের সম্পর্ক যে নিগুড় তা’ই বলার চেষ্টা করেছি, যদিও কোন লেখাই সম্পূর্ণ হতে পারে না, আমার এটাও তেমনি।

রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্য ভাব’এ সুগভীর, গীতিময়, চিত্ররূপময়, আধ্যাত্বিক ও ঐতিহ্যপ্রীত। এতে রয়েছে অনাবিল প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্য চেতনা, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বিপুল বৈচিত্র্য আর সেই সাথে বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদী ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞান চেতনা এবং শিল্পদর্শনের প্রভাব তাঁর রচনায় গভীর। তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছেন কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে। সমাজ কল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শন চেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেবদেবী গ্রহের পরিবর্তে মানুষ অর্থাৎ কর্মী ঈশ্বরকে পূজার কথা বলতেন। সঙ্গীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাঁর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা …………’ ও ‘জনগণমন- অধিনায়ক জয়হে …………….’ গানদুটোও বাংলাদেশ আর ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত। বলা বাহুল্য , রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রতিভায় বহুমাত্রিক আর তাই কৃষ্ণা দত্ত ও এন্ড্রু রবিনসন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বহুরূপী মানসের মানুষ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেন’নি কিন্তু সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা বিস্ময়ের। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অসামান্য প্রতিভাবান ব্যক্তি। বাল্যকালেই তাঁর কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র পনের বছর বয়সে তাঁর বনফুল কাব্য প্রকাশ হয়। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ করেন W.B Yeats, অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ছবিও আঁকতেন। চিত্রাঙ্কনে কোনো প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। প্রথমদিকে তিনি লেখার হিজিবিজি কাটাকুটি গুলিকে একটি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এই প্রচেষ্টা থেকেই তাঁর ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে। তাঁর তৈরী স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপর যার ১৫৭৪’টি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। এগুলোর কিছু নিয়ে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় পারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর ইউরোপে কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ছবিতে রং ও রেখার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের ব্যবহার করতেন। মূলত কালি-কলমে আঁকা স্কেচ, জলরং ও দেশজ রঙের ব্যবহার করে তিনি ছবি আঁকতেন। তাঁর ছবিতে দেখা যায় মানুষের মুখের স্কেচ, অনির্ণেয় প্রাণীর আদল, নিসর্গদৃশ্য, ফুল, পাখি ইত্যাদি। তিনি নিজের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন। তিনি একাধিক অঙ্কন শৈলী রপ্ত করেছিলেন। তন্মধ্যে, কয়েকটি শৈলী হল: নিউ আয়ারল্যান্ডের হস্তশিল্প , কানাডা (ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশ) পশ্চিম উপকূলের “হাইদা” খোদাই শিল্প ও ম্যাক্স পেকস্টাইনের কাঠখোদাই শিল্প [1]।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫) এবং মাতা ছিলেন সারদা সুন্দরী দেবী (১৮২৬–১৮৭৫)। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তা। রবীন্দ্রনাথের পূর্ব-পুরুষেরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলা পিঠাভোগে বাস করতেন [2]। ১৮৯০-৯১, কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলের জমিদারির তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময় দীর্ঘ কয়েক বছর সপরিবারে কলকাতা ও শিলাইদহে পর্যায়ক্রমে বসবাস করেন। বলা বাহুল্য, অস্পৃশ্যতা প্রথার কারণে কেবল মাত্র পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ ) যশোর , খুলনা , পিরালী ব্রাহ্মণ কন্যারাই ঠাকুর পরিবারের বধু হয়ে আসতেন।

কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে ‘পদ্মা’ নামে একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজাবর্গের কাছে খাজনা আদায় ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন। এখানেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন বহু গ্রন্থ এবং বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেন এক নতুন ধারা, ছোটগল্প। সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬), এবং কথা ও কাহিনী কাব্যগ্রন্থগুলি এই সময়েরই রচনা। এছাড়াও একাধিক উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন এই সময়।

তার লেখা থেকে সামান্য নমুনা:

শিলাইদহে পদ্মা নদীতে নৌকায় আমি একা, সঙ্গে ছিল এক বুড়ো মাঝি , আর এক ছিল চাকর – নাম ফটিক । নৌকা বাঁধা থাকত পদ্মার চরে। সে দিকে ধু ধু করত দিগন্ত পর্যন্ত জনহীন, তৃণ শস্যহীন দিগন্ত। মাঝে মাঝে জল বেধে আছে, সেখানে শীত ঋতুর আমন্ত্রিত জলচর পাখির দল । নদীর ওপারে গাছপালার ছায়ায় মানুষের জীবনযাত্রা। মেয়েরা জল নিয়ে যায়, ছেলেরা জলে ঝাপদিয়ে সাঁতার কাটে, চাষিরা গরু নিয়ে পার হয়, নৌকা গুনের টানে ধীর গতিতে চলতে থাকে , ডিঙ্গি নৌকা পাটকিলে রঙের পাল উড়িয়ে হু হু করে জল চিরে যায়। মানুষের দুঃখকষ্ট আমার গোচরে এসে পড়ত, তাদের নানান নালিশ নিয়ে। পোস্টমাষ্টার গল্প শুনিয়ে যেত মানুষের সদ্য ঘটনা ও তার নিজের সমস্যা নিয়ে। নৌকা ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মা থেকে পাবনা কোলের ইছামতিতে, সেখান থেকে বরলে, হুড়ো সাগরে, চলন বিলে, আত্রাইয়ে নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাতপুরের খাল বেয়ে সাজাতপুরে। দুই ধারে কত টিনের ছাদওলা গঞ্জ, কত মহাজনী নৌকার ভিড়ের কিনারায় হাট। ছেলেদের দলপতি ব্রাম্মন ছেলে, গোচরনের মাঠে রাখাল ছেলের জটলা, বন ঝাউ-আচ্ছন্ন পদ্মাতীরের উঁচু পাড়ির কোটরে কোটরে গাঙ শালিকের উপনিবেশ। আমার গল্পগুচ্ছের ফসল ফলেছে আমার এই পথে-ফেরার বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভুমিকায়। সেদিন আমি যে কেবল পল্লীর ছবি এঁকেছি তা নয়, পল্লী সংস্কারের কাজ শুরু করেছি তখন থেকেই – সে সময়ে আজকের দিনের পল্লি দরদী লেখরেরা ‘দরিন্দ্র নারায়ণ’ শব্দটির সৃষ্টিও করেন নি। সেদিন গল্পও চলছে, তারই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সুত্রে বাঁধা জীবনও চলছে এই নদী মাতৃক বাংলাদেশের আথিত্য।

লেখক রেজাউল হক, ব্লগার


এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সিলেটি ভাষা ও সংস্কৃতি

নতুন সমাজ ব্যবস্থায় হাটছি আমরা

প্রসঙ্গ: ধর্মওয়ালা শাসক শোষক বনাম অভিজিৎ