ধর্ষণ নিয়ে কিছু কথা!
প্রত্যেক মানুষই প্রত্যাশা করেন উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপদ একটি জীবন নির্বাহ করার। কিন্তু এই প্রত্যাশা টা যেন অমাবস্যার চাঁদ! উন্নত ও শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য পরিশ্রম, অধ্যবসায়,আমাদের আশেপাশের পরিবেশ ও আমাদের জীবনের কিছু সিদ্ধান্তের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা? ওটা তো আমাদের মৌলিক অধিকার তাই না? কিন্তু তাও কেনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে আমাদের দেশের নারী সমাজ?
বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে নারী নির্যাতন ও নারীদের প্রতি অবহেলা। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও এই দিকটা ঠিক পরিবর্তন হলো না বরং সময়ের সাথে সাথে যেন বেড়ে যাচ্ছে নির্যাতন ও ধর্ষণের হার বাংলাদেশে, গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী কিংবা ছয় বছরের শিশুও৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে এসব নারী ও শিশুকে৷ বিচার না হওয়াকে এই পরিস্থিতির জন্য দুষছেন মানবাধিকারকর্মীরা৷
সিলেটের এমসি কলেজে শুক্রবার সন্ধ্যার পর স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ এই ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ ব্যস, বাঁচার জন্য আর কি দরকার? ক্ষমতাসীন দল মানেই তো বিচার কার্য তাদের হাতে, প্রথম কয়েকদিন গুঞ্জন শোনা যাবে ছাত্রছাত্রীরা মাঠে নেমে আসবে। পরে আবার অন্য একটা ইস্যু বের করবে ক্ষমতাসীনরা, মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়বেন সেটি নিয়ে। আড়ালে পড়ে যাবে এই এম সি কলেজের ধর্ষণের ঘটনা। পরিস্থিতি সামাল দিতে লোক দেখানো যাবে, রোববার ভোররাতে মামলার প্রধান আসামি সাইফুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷
দুই দিন আগে খাগড়াছড়িতে ডাকাতি করতে ঘরে ঢুকে এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ এছাড়াও সম্প্রতি দেশের বিভিন্নস্থানে এমন আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে৷ ছয় বছর ও ১৩ বছরের শিশুকেও ধর্ষণ করেছে দুর্বৃত্তরা৷
আমার শহর সিলেটের ছাত্রলীগ কর্মীদের ধর্ষণের শিকার তরুণীর কথায় বলা যাক, শুক্রবার সন্ধ্যার পর স্বামীর সঙ্গে সিলেটের এমসি কলেজে বেড়াতে গিয়েছিলেন এক তরুণী৷ সেখানেই কয়েক যুবক স্বামীকে গাড়িতে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে৷ এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে সিলেট নগরীর শাহপরাণ থানায় মামলা করেছেন৷ মামলায় ছাত্রলীগের ছয় কর্মী ও অজ্ঞাত তিনজনকে আসামি করা হয়েছে৷ আসামিরা হলেন, এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাছুম, রবিউল হাসান, তারেক আহমদ ও অর্জুন৷
এর মধ্যে রোববার ভোররাতে সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে পুলিশ সাইফুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার ওসি আনোয়ার হোসেন মৃধা খবরটি নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে সিলেট পুলিশের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে৷’’
এর আগে শনিবার সিলেট মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিষয়টি আমরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি৷ একাধিক টিম অভিযান শুরু করেছে৷ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারিনি সত্যি, কিন্তু আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে৷ আমরা ভিকটিমের জবানবন্দি নিয়েছি৷ অভিযুক্তদের শিগগিরই গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আমি আশাবাদি৷’’
এদিকে এই ধর্ষণের ঘটনার পর এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ‘ছাত্রলীগের দখলে’ থাকা হিসেবে পরিচিত একটি কক্ষে অভিযান চালিয়ে পুলিশ একটি পাইপগান, চারটি রামদা ও দুটি লোহার পাইপ উদ্ধার করে৷ কক্ষটি ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাইফুর রহমানের৷ পরে তার নামে অস্ত্র আইনেও শনিবার আরেকটি মামলা ও নাকি হয়েছে৷ এই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন সিলেটের ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিার্থীরা৷ জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজের সামনে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন৷ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ থাকার পরও ছাত্রাবাস কীভাবে খোলা রাখে কলেজ কর্তৃপক্ষ?? এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ অবগত থাকার পরও কেন ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেয়া হলো না?? এজন্য কর্তৃপক্ষেরও দায় আছে বলে মনে করেন তারা৷ কিন্তু ক্ষমতার কাছে শিক্ষা যে এখন একটি ব্যবসা এটি বুঝার বাকি নেই কারো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই হোস্টেলটি একটি অরক্ষিত হোস্টেল৷ কোন সীমানা প্রাচীর নেই৷ আমরা কয়েকবার সেখান থেকে বখাটেদের বের করে দিয়েছি৷ এমনকি রুমের তালাও পরিবর্তন করেছি৷ কিন্তু তারপরও এই ঘটনা ঘটে গেল৷ এই ঘটনায় আমি লজ্জিত, আমার মাথা নিচু হয়ে গেছে৷ আমি অসহায়৷ একটা ঐতিহ্যবাহি কলেজে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত৷’’এজন্য ধান ভানতে শিবের গীত, গাঁজা খাবো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যই অধ্যক্ষের বক্তব্যটি যথার্থ ছিল বটে। কিন্তু তারই বা কি দোষ ক্ষমতার কাছে সবাই তখন খুদে পিপড়ে।
ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে ২০১৯ সালের এক হিসেবে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরের ৫০টি থানা এলাকায় ধর্ষণ ও গণধর্ষণের অভিযোগে প্রায় ৫০০ (৪৯৮) মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গণধর্ষণের মামলার সংখ্যা ৩৭টি। সিলেটে মামলার সংখ্যা ৩০০ এর কাছাকাছি, আবার মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ১৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২ জন৷ অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি৷ ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী৷ ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে৷ আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী৷
ধর্ষণের কারণ কি?সোজা কথায় এর উত্তর হলো হলো ‘ পারিবারিক শিক্ষার অভাব ও মানসিক সমস্যা’। কিন্তু কিছু শ্রেণীর মানুষ মনে করেন যে ‘ধর্ষনের জন্য মেয়েদের পোশাক দায়ী’। তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন উঠতেই পারে ‘ তাহলে বোরকা পরা মহিলাদের কেন ধর্ষন হয়? ৪-৫ বছরের বাচ্চাদের কেন ধর্ষণ হয়?’
ধর্ষন নিয়ে এক লেখায় লেখক শিফা সালেহিন শুভ একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেছেন, লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক সৌদি থেকে ফিরে নিজ নিজ দেশে ফিরে জানিয়েছেন তাদের বীভৎস সব অভিজ্ঞতার কথা।তারা বলেছেন, প্রতিদিন তারা ধর্ষিত হয়েছেন গৃহকর্তার কাছে, বারংবার, বাবা-ছেলে একসাথে ধর্ষণ করেছে, বন্ধুরা মিলে ধর্ষণ করেছে, শারিরীক মানসিক নির্যাতন করেছে, এসব নোংরা কাজে সেইসব পরিবারের মেয়েরাও কোন বাঁধা দেয়নি।
এইসব ঘটনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা৷ নারী নেত্রী খুশি কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এইসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না৷ আবার অনেক সময় পুলিশ এইসব ক্ষমতাশালীদের গ্রেফতারও করে না৷ আমি তাদের কথা বলছি, যারা রাজনৈতিকভাবে বা আর্থিকভাবে ক্ষমতাশালী৷ কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে৷ ফলে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমাজে খুব ভালো বার্তা যাচ্ছে না৷ এই কারণে এদের থামানোও যাচ্ছে না৷ এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অবশ্যই অপরাধ কমে যাবে৷’’ তাহলে আসল অপরাধী কে? ধর্ষক, না আমাদের সমাজের মনোভাব?
একজন ধর্ষক ধর্ষণ করার সাহস পায় আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থার জন্যই। ভারতের মধুমিতা পান্ডে তিহার জেলে একশ কুড়িরও অধিক ধর্ষককে নিয়ে এক সমীক্ষা শুরু করেন ২০১২ সালে নির্ভয়ার ঘটনার পর৷ তিনি সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হন এটা দেখে যে তাদের কারও মধ্যেই বড় একটা অনুশোচনা বা অনুতাপ দেখা যাচ্ছে না। অধিকাংশই তখনও মনে করেন, এক হাতে তালি বাজে না৷ মেয়েরা আগ বাড়িয়ে তাদের নাকের ডগায় ঘুরে না বেড়ালে ‘রেপড’ হত না৷ এইসব পুরুষরা, বলাই বাহুল্য, টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বা বিষাক্ত পৌরুষের ধারণাতেই ভুগছেন।
মধুমিতা বলেন,
“Men are learning to have false ideas about masculinity, and women are also learning to be submissive. It is happening in the same household.”
এখানেই ধর্ষণের উৎস লুকিয়ে আছে বলে তিনি মনে করেন, পুরুষের উগ্র ও নারীর দুর্বল ও সর্বংসহা হওয়ার শিক্ষার মধ্যে।
তিনি আরো বলেন , “Everyone’s out to make it look like there’s something inherently wrong with [rapists]. But they are a part of our own society. They are not aliens who’ve been brought in from another world.”
যা হোক ধর্ষণ ও ধর্ষককে নিয়ে আরো বলতে গেলে শেষ হবে না।
পরিশেষে বলবো, ধর্ষনে ভিক্টিমের কোনো দোষ থাকে না। তবুও তাকে পরবর্তী জীবন আধমরা হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। সমাজে মুখ লুকিয়ে থাকতে হয়। যার একমাত্র কারণ আমাদের ‘Not soo flexible’ সমাজ। কিন্তু এই ধারা পাল্টানোর সময় অনেক আগেই চলে এসেছে। আমাদের উচিত ভিক্টিমদের কোনো ভাবে হাইলাইট না করে তাদের সাধারণ জীবন যাপন করতে দেওয়া। এবং ধর্ষককে হাইলাইট করতে হবে ও এমনভাবে বয়কট বা শাস্তি দিতে হবে, যাতে সে সমাজে বেঁচে থাকার কোনো আশ্রয় না পায়।
লেখক :ব্লগার,রেজাউল হক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন