স্বপ্নের একুশে কি নিরাপদ হবে সড়ক?
বিশে বিষাক্ত হয়ে গেছে আমাদের এই চলতি বছর, করোনা মহামারী পুরো বিশ্বকে করে দিয়েছে স্তব্ধ। এক অচেনা আচর সামলাতে হিমশিম পুরো বিশ্বের। হাজারো মানুষের প্রাণনাশ ধস নেমিয়েছে অর্থনীতিতে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ভয়ে কাতর। ইতালি ফ্রান্স সহ যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য এ প্রাণহানি থেকে রেহাই পায়নি। বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। এই মহামারী মধ্যেও থেমে নেই রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল।
এ বছরের মার্চ থেকে দেশে লকডাউন শুরু হয়। এর কয়েক মাস পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সীমিত আকারে যানবাহন খুলে দেওয়া হয়। এর মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনা থেমে থাকেনি। নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) তথ্যমতে, চলতি বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৯২টি, প্রাণ গেছে ৪ হাজার ৯৬৯ জনের। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৫ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। গবেষণা বলছে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া লোকজনের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত লোকজনের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু, তাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি ও দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট যানজট অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
রাজধানী ঢাকা বহু রাজনৈতিক আন্দোলন–সংগ্রামের সাক্ষী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সব শ্রেণির মানুষকে নাড়া দিতে পেরেছে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন। প্রতিবাদের ধরন, পোস্টার–লিফলেটের ভাষা এবং শিক্ষার্থীদের একাগ্রতা সারা দেশের মানুষকেই তাদের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য করে।আর ২০১৮ এর আগস্টের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে। প্রথম আলো দৈনন্দিন খবরের বাইরেও পরিবহন খাতে চালকের সংকট, যানবাহনের ফিটনেসের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ সড়কের চিত্র এবং এ খাতে কীভাবে রাজনীতিকেরা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা তুলে ধরে। চাঁদাবাজিসহ পরিবহন খাতের যেসব অনিয়ম সড়কে শৃঙ্খলা আনার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে, সেগুলো নিয়মিতই খবর হয়।
সরকার চাপের মুখে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদে পাস করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮।বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক আইন পাশের পর প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও এখনো আইনটি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি
স্বপ্নের একুশ সালের আর মাত্র তিন মাস । এই ৩ মাসে আগেও দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে অপরিকল্পিত। মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না।২০ সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। ওই দিন সকালে খাগড়াছড়িতে একজনের মৃত্যু। ১৯ সেপ্টেম্বর বান্দরবান জেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডে ৬ পর্যটক আহত এবং রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় এক দম্পতির মৃত্যু হয়। একই দিনে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কে এক কলেজ ছাত্রের মৃত্যু ও মাদারীপুরে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রাণ গেছে দুজনের। গত দুই দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ৮ এবং আহত হয়েছেন ৬ জন। অপ্রকাশিত রয়েছে অসংখ্য। কয়েক দিনের পরিসংখ্যানটি যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে আগামী ৩ মাসে এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। স্বপ্নের একুশে কি নিরাপদ হবে সড়ক?
এই একুশ মানুষের কাছে স্বপ্নের একুশ। কিন্তু এই স্বপ্নের মধ্যে ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলো ঝরে যাচ্ছে। বিলীন হয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলো। সরকার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে এবং দেশের মানুষকে নিরাপদ রাখতে সড়কের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো ফিটনেসবিহীন গাড়ি। বর্তমানে রাস্তায় বের হলেই তা চোখে পড়ে। ফিটনেসবিহীন হয়েও তাঁরা চালাচ্ছেন বেপরোয়াভাবে এবং লাইসেন্সও নেই। এর ফলে প্রতিদিন ঘটে যাচ্ছে বড় বড় সড়ক দুর্ঘটনা এবং অকালে প্রাণ যাচ্ছে ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলোর। অবৈধভাবে ফিটনেসবিহীন গাড়ি দিনের পর দিন চলেই বা কী করে? কি করেই বা লাইসেন্স পেয়ে যাই কোনরকম যোগ্যতা ছাড়াই? কাদের ছত্রছায়ায় এগুলো হয় সেগুলো খতিয়ে দেখা দরকার । না হয় স্বপ্নের একুশে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর করা চ্যালেঞ্জ এর বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
এক সময় দেশে সড়ক দুর্ঘটনাকে নিয়তি বলে মেনে নেওয়া হতো। বলা হতো, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। স্ত্রীকে হারিয়ে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন যখন শুরু করেছিলেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন, তখনও অনেকেই নানা কথা বলেছিলেন। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীই বলেছিলেন, ‘কী দরকার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর?’ কিন্তু কারও কথায় কান দেননি তিনি। আলিঙ্গন করে নিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জকে। হার মানেননি, চালিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ নিঃস্বার্থভাবে আপামর মানুষকে সচেতন করার যুদ্ধ।
নিশাচর ক্লান্ত পরিশ্রম থেকে যে বিষয়টি অর্জিত হয়েছে—তা হলো ‘সড়ক দুর্ঘটনা ভাগ্যের লিখন’ এমন ভ্রান্ত ধারণা থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে। এখন সবাই বোঝেন, সড়ক দুর্ঘটনা কপালের লিখন নয়, কারও না কারও গাফিলতির জন্য, অনিয়মের জন্য দুর্ঘটনা ঘটছে। এটা শুধু নিয়তির বিষয় না। মূলত এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অগ্রগতি। কেননা সমাজের কুসংস্কার, অসঙ্গতি ও সমস্যাগুলোকে নিয়তি বলার সুযোগ আর নেই। সম্মিলিত সামাজিক শক্তি নিয়ে এগুলো মোকাবিলা না করলে সমাজ এগোবে না।
সুতরাং, বর্তমান সরকারের উচিত বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশের সঠিক লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য সড়কপথ নিরাপদ করা। দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করে সেই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা এবং সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া। তাহলেই স্বপ্নের একুশে স্বপ্নগুলো অকালে ঝরে যাবে না। আগাম ভবিষ্যতে তারাও ডিজিটাল বাংলাদেশ ধরে রাখার হাল ধরতে পারবে।
লেখক: ব্লগার,রেজাউল হক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন