ক্ষমতার দাপটে অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন!

 কথা বলছিলাম সিলেটে অবস্থিত সুরমা নদীর কথা। অপকর্ম আর দুর্নীতির ছোঁয়ায় নদীটার প্রাণ যেন হারতে বসেছে, নদীটি আজ প্রায় মৃত। বর্ষা মৌসুমে নদীতে অনেক পানি দেখা গেলেও শীতের মৌসুমে তলদেশে চলে যায় নদীর পানি। বর্ষাকালে ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলতে পারলেও শীতের মৌসুমে অনেক জায়গা দিয়ে পায়ে হেটে পার হয়ে যায় দুরন্ত কিশোরের দল। সুরমা নদীর ভাঙ্গন,নদীর ভারসাম্য নষ্ট,নদীর গতিপথ ও ভৌগোলিক চিত্র পাল্টে যাচ্ছে কতিপয় লোভী  ক্ষমতাসীনদের কারণে। নদীকে ঘিরে সভ্যতার ইতিহাস যে পথে হেঁটেছে এ ভূখণ্ডে তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর এ কারণেই সিলেটে বাসির জন্য এই নদী গুলো এক সময় আশীর্বাদ হয়ে আসে। কিন্তু সময়ের পথ পরিক্রমায় এগুলো ই এখন মানুষের জন্য দুঃখ দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রতি বছর নদী ভাঙ্গানে গৃহহারা হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ তার সাথে বাংলাদেশের প্রায় সময়ই নদীর উপর বয়ে যাওয়া সেতু গুলোর খুঁটি ভেঙে পড়া রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার এগুলো নতুন কিছু নয়। আর এসব নদীভঙ্গন সেতু মেরামতে প্রতি বছর কাজ করে যাচ্ছে সরকার, ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু কেন এই নদী ভাঙ্গন, নদীর মৃত্যু গতিপথ পরিবর্তন,কেনইব ভিত্তিস্থাপন দুর্বল হয়ে যায় তার বিরুদ্ধে কি কখনো তদন্ত করেছে সরকার??? প্রশ্ন রইলো আপনাদের কাছে? 



  সেদিন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হলাম, বাসা থেকে বের হয়ে সিলেট সুনামগঞ্জ বাইপাস রোডে তেমুখি ব্রিজে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম বন্ধু সাইফুল্লাহ আল-জেহিনের এর জন্য।তখনই হঠাৎ চোখে পড়ে সুরমা নদীর উপর বসেছে ড্রেজার। সুরমা নদী থেকে ইজারা ছাড়াই অবাধে বালু উত্তোলন করছেন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। ফলে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার এবং হুমকি র মুখে পড়েছে এই বালু ঘাটের পার্শ্ববর্তী তেমুখি ব্রীজটি ও ফসলি জমি। তাও আবার ব্রিজের মূল খুঁটি থেকে পাঁচ থেকে দশ ফুট দূরে। আমি তো প্রায় অবাক এতে তো নদী ভাঙ্গন ব্রিজের ভিত্তি স্থাপন দুর্বল সহ নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে। কৌতূহল এর ভিত্তিতে নিচে নেমে গেলাম।স্থানীয় দের অভিযোগ, ‘রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রভাবশালী মহল অবৈধ ভাবে সুরমা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে আসছে। এতে প্রতি বছর ওই এলাকার শত শত বসত ভিটা, রাস্তাঘাট ও ফসলী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরে ও ভাঙনে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে।  



 ২০১৫ সালে সুরমা নদীর দক্ষিণ সুরমা অংশে কুচাই এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে বেলার পক্ষ থেকে রিট করা হয়েছিল।২০১৬ সালে বেলার এই রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পরিবেশগত সমীক্ষার পর সুরমা নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথচ তা বন্ধ হয়নি। এখনো অবাধে বালু তুলে আসছে ক্ষমতাসীনরা।


 বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ এর ধারা ৫ এর ১ উপধারা অনুযায়ী পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। ধারা ৪ এর (খ) অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারী স্থাপনা হলে অথবা আবাসিক এলাকা থেকে সর্বনিম্ন এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।আইনটির ৪-এর ‘গ’ ধারায়, বালু বা মাটি উত্তোলন বা বিপণনের উদ্দেশ্যে ড্রেজিংয়ের ফলে কোন নদীর তীর ভাঙ্গনের শিকার হতে পারে এরূপ ক্ষেত্রেও বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ। অথচ এসবের তোয়াক্কা না করেই একই আইনের ৫নং ধারার ভূ-গর্ভস্থ বা নদীর তলদেশ হতে বালু বা মাটি উত্তোলন সংক্রান্ত বিশেষ বিধানও অমান্য করে সিলেটের জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমেদ নিজেই বালু উত্তোলন করে সরকারি জায়গা দখল করছেন আবার বালু বিক্রি ও করছেন।



নদীর দুই অংশের স্থানীয় বাসিন্দা দের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে নিয়ম উপেক্ষা করে অবৈধ ভাবে বালু তুলছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান  আশফাক  আহমেদ, আর সাথে জড়িত আছেন অত্র এলাকা কান্দির গাঁও চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন, ও টুকের গাও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহীদ আহমেদ সহ প্রভাবশালী মহল। এর মূল হোতা আশফাক আহমদ। যিনি তাঁর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ট্রাক্টর চালকেরা জানায়, তারা প্রতি ট্রাক্টর ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করে বালু কেনে। এখানে চলা ট্রাক্টর গুলো নাকি আশফাক আহমেদ এর নিজস্ব। অর্থাৎ তিনি বালু তুলেন আবার সাথে যারা আছেন তাদেরকে ভাগ না দেয়ার জন্য নিজেই আবার সেই বালু কিনে নেন। আবার সিন্ডিকেট করে সেই বালুর দাম তিনি বাড়িয়ে দেন বাজারে। এ তো দেখছি সূক্ষ্ম কারসাজি। একে তো অবৈধ বালু তার ওপর আবার সিন্ডিকেট করে দাম দেয়া হয়েছে বাড়িয়ে। পড়াশোনা করে ভালো চাকরি না খুঁজে ভালো ভাবে রাজনীতিতে মন দিলে আর একটা পদ জোটাতে পারলে টাকা যেন আপনার পিছু ছাড়বেনা এটাই এখন বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট।


এরপর বিভিন্ন এলাকায় প্রতি ট্রাক্টর বালু ৮০০-১১০০ টাকা দরে বিক্রি করে তারা। টুকের বাজার ঘাট থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাক্টরে বালু পরিবহন করা হয়। প্রতিটি ট্রাক্টর প্রতিদিন কমপক্ষে ৩-৪ বার করে বালু নিয়ে যায়। অনন্তপুর খিলপাড়া গ্রামের কৃষক সৈকত হোসেন জানায়, এখানে বালু উত্তোলনের ফলে আমাদের অনেক ফসলি জমি ইতোমধ্যে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।


করোনার সময়ের ৩ মাস অর্থাৎ মার্চ থেকে মে সবার মনোযোগ যখন করোনা কে নিয়ে ঠিক তখনই আশ পাশের ব্যক্তি মালিকানা জমিসহ সরকারি খাস জমি বালু ফেলে ভরাট করে দখল করে নিয়েছে আশফাক আহমেদ। তাহলে বালু মহল আর ভূমি অধিদপ্তর এর কাজ কি শুধু জরিপ করা ??যখন আইন অমান্য করে অবাধে বালু তুলে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা তখন কি তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে?? নাকি ক্ষমতাসীনদের জন্য এখনো কোনো আইন তৈরি হয়নি বাংলাদেশে??



বাংলাদেশের বর্তমান পেক্ষাপটে কোন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কথা বললে গুম এবং হুমকির সম্মুখীন হওয়া স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠেছে। মানুষের বাকশক্তি যেন এখন ক্ষমতার কাছে হার মেনে গেছে।আর তাই তো অবৈধ বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সবাই ক্ষমতাশীল ও প্রভাবশালী হওয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন তাঁদের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো অভিযোগ দিতেও সাহস পাচ্ছেন না। 


বর্তমান অবস্থা অনেকটা মগের মুল্লুকের মতো। যার যা খুশি করছে। কিন্তু কারও যেন কিছু বলার নেই। এই বালু উত্তোলনের মাধ্যমে একদল মানুষ অবৈধভাবে টাকা কামাচ্ছে, আর অন্যদিকে মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে। গুটিকয়েক সুবিধাভোগীর অবৈধ কর্মকাণ্ডে কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের জীবন হুমকির মধ্যে ফেলা যায় না।ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করলে নদীর গতি পরিবর্তিত হয় এবং নদীর দুই পাড় ভেঙে যায়। অর্থাৎ নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে প্রকৃতিরও ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষত রোধ করতে হবে।এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমারা সাধারণ জনগণ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।


লেখক:ব্লগার,রেজাউল হক।





 




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সিলেটি ভাষা ও সংস্কৃতি

নতুন সমাজ ব্যবস্থায় হাটছি আমরা

প্রসঙ্গ: ধর্মওয়ালা শাসক শোষক বনাম অভিজিৎ