ধর্ম ও রাজনীতি!

 মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা, আবার মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকেরা তারপরেও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক। আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক। হুমায়ুন আজাদের এ কথায় যেন বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে ইঙ্গিত করে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাধ্যমে ফায়দা হাসিল করা হচ্ছে এখন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিগত বছর বিজয় দিবসে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে যেন উচ্চারিত হয়েছে এক নতুন শপথ। ভাস্কর্য তথা মূর্তির বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক শক্তি নতুন করে ফণা তোলার কারণেই এক ধরনের প্রতিবাদী মনোভাব বিজয় দিবস উদযাপনকে ঘিরে দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনাও এবার বিজয়ের মাসে ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় বলেছেন, “মনে রাখতে হবে, সকলে এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে রক্ত ঢেলে দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছি। যার যা ধর্ম তা পালনের স্বাধীনতা সকলেরই থাকবে। আমরা সেই চেতনায় বিশ্বাস করি এবং ইসলাম আমাদের সে শিক্ষাই দেয়।” 



প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, “আমি একটা কথাই বলব, এই মাটিতে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সকল ধর্মের মানুষের বসবাস থাকবে অর্থাৎ আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে অন্য ধর্মকে অবহেলার চোখে দেখবো না।”

রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে সরকার তার নীতিতেই কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমিও মনে করি শেখ হাসিনার কথাটির যথার্থ ব্যবহার হোক, এমনটাই হওয়া উচিত। কিন্তু কথার সাথে  আদৌ কি কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বাস্তবে কি সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হয়েছে? কখনো কি ছিল? সংখ্যাধিক্য আর সংখ্যাল্প সম্প্রদায় কি এক অবস্থানে আছে? আমার মতে বিষয়টি একটু আলোচনার দাবি রাখে।

আমরা পাঠ্যপুস্তকে মানুষকে তার কর্মের দ্বারা বিচার করার কথাটা শুনলে ও বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।মানুষকে সংখ্যা দিয়ে গণনা করে সংখ্যাধিক্য এবং উনজন হিসেবে বিচার করাটা অনুচিত হলেও এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপীই হয়ে আসছে। সংখ্যাধিক্যরা বিশ্বের প্রায় সব দেশে, সব সমাজ ব্যবস্থায় কিছুটা ব্যতিক্রম, অধিকার আর মর্যাদার ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতর। যদিও অনেকে মনে করে এটি মূলত ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করা হয়, কিন্তু নির্মম এই পৃথিবীতে আরো নানাভাবেই এই ভাগ-বিভক্তি করা যায়, করা হয়।  শুধু ধর্ম নয়, মানুষের বর্ণ (গায়ের রং), বিশ্বাস, চিন্তা ইত্যাদি দিয়েও সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু মাপকাঠি হয়ে থাকে।


এ নশ্বর পৃথিবীতে মোটা দাগে ধর্মবিশ্বাসীরা সংখ্যাধিক্য আর ধর্মে অবিশ্বাসীরা উনজন । আর আস্তিক-নাস্তিক লড়াই নতুন কিছু নয়। কোথাও সাদা রঙের মানুষ সংখ্যাগুরু, কোথাও কালো রঙের। কোথাও মুসলমান সংখ্যাগুরু, কোথাও হিন্দু, কোথাও খ্রিস্টান, কোথাও বৌদ্ধ কিংবা অন্য কোনো ধর্ম বিশ্বাসী। এক ধর্মের মানুষের মধ্যেও সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু আছে, থাকতে পারে। যেমন কোথাও শিয়া মুসলমান সংখ্যালঘু, কোথাওবা সুন্নি। খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক প্রোটেস্টান আছে। হিন্দুদের বর্ণ বিভাজন তো মারাত্মক।

তবে এখন শুধু ধর্ম আর বর্ণ নয় আরো নানান বিষয়ে ও বৈষম্য তৈরী হয়েছে। শুনতে অবাক লাগলেও বিশ্বাস এবং চিন্তার ক্ষেত্রেও সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু আছে। তবে আমরা বাংলাদেশে প্রধানত ধর্মের ভিত্তিতেই সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু নির্ধারণ করে থাকি। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু আর সনাতন ধর্ম বিশ্বাসীরা উনজন। বাংলাদেশের ৯০% মানুষ ইসলাম ধর্মী।


এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যখন একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দুই খণ্ড হয়ে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটল তখন স্বভাবতই আশা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি আর পাকিস্তানি কোনো লিগাসি বা মন্দ উত্তরাধিকার কিংবা ধারা বহন করবে না। পাকিস্তান ছিল ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্রটি হবে অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চরিত্রের। ধর্ম হবে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, আচরণ ও পালনের বিষয়। রাষ্ট্র হবে সবার, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান– সব মানুষের। এমনকি গরিবের, নিঃস্বের, ফকিরেরও। রাষ্ট্র বিশেষ কোনো ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। বিত্তবান এবং বিত্তহীনদের যে বৈষম্য অর্থাৎ ধনবৈষম্য কমিয়ে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র্রের আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে। কারণ দেশটা যে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মালম্বীরা স্বাধীন করেছেন তা কিন্তু নয়। কিন্তু সংবিধানের এই লেখা বাস্তবে কতটা প্রয়োগ হচ্ছে??


দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু সংবিধান মানার কোনো নজির আজও চোখে পড়েনি। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই আমাদের মনোভূমির রং বদলাতে লাগল। আজ তা উজ্জ্বলতা হারিয়ে প্রায় ফ্যাকাশে। 


রক্তক্ষয়ী নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, তখন সর্বপ্রথম ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলো। সেদিন ভারতীয় পার্লামেন্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবেগ জর্জরিত কন্ঠে ভাষণ দিয়েছিলেন। তার জবাবে তৎকালীন বিরোধী নেতা জনসংঘের (এই জনসংঘের পরিবর্তিত নাম – বিজেপি, ভারতীয় জনতা পার্টি) অটল বিহারী বাজপেয়ী বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে স্বাগত জানিয়ে একটু বিদ্রুপের সুরে ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশে বলেছিলেন, “আপনার বাবা (জওয়াহের লাল নেহরু) একটি পাকিস্তান তৈরি করতে সহযোগিতা করেছিলেন, আপনি (ইন্দিরা গান্ধী) দুইটি পাকিস্তান তৈরিতে সহযোগিতা করলেন, আপনাকে অভিনন্দন!”





অটল বিহারী বাজপেয়ীর বক্তব্যটি অনেকের মন বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছিল।তিনি একটি সাম্প্রদায়িক দলের নেতা বলেই অমন বিদ্বিষ্ট মন্তব্য করেছিলেন বলে আমাদের মনে করেছিলাম। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত রক্তস্রোত সাঁতরে যে দেশ স্বাধীন হলো সে দেশ আবার পাকিস্তানমুখী হবে – সেটা ছিল আমাদের তখনকার চিন্তার বাইরে! জাতি হিসেবে আমরা একটু আবেগপ্রবণ। যুদ্ধ জয়ের উন্মাদনা, নতুন দেশ, নতুন পতাকা, নতুন জাতীয় সঙ্গীত পাওয়ার উত্তেজনায় আমরা তখন আবেগ-উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছিলাম। কিছুটা যুক্তিরহিত আচরণ করেছিলাম। মানুষের মনোজগতের পরিবর্বতন যে রাতারাতি হয় না, সেটা যে ধারাবাহিক চর্চা ও সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে হয় – তা আমরা তখন ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করিনি। আর সেই গ্লানি এখনো আমাদের তারা করে চলে।


তবে কিভাবে সম্ভব হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার প্রত্যয় থেকে আমরা কীভাবে সরে আসার, নিজেদের মানুষ হিসেবে না ভেবে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিচিত করার প্রবণতা কীভাবে আমাদের পেয়ে বসল – সে বিষয়গুলো গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা দাবি রাখে। বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। যারা যখন ক্ষমতায় থাকেন তারা তখন এই কথাটা বেশি উচ্চারণ করেন। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকতেও এই আপ্তবাক্য উচ্চারিত হয়েছে। বাংলাদেশে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সব মানুষ সমান সুযোগ ও অধিকার ভোগ করে থাকে বলে যে দাবি করা হয় তা যথার্থ নয়। এটা ঠিক যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশে তা দীর্ঘ দিন ধরেই হয়নি বা হয় না। তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই। এক সময় হয়তো কিছুটা প্রচ্ছন্ন ছিল, এখন তা প্রকট এবং প্রকাশ্য হয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার পরিবর্তে তাকে তার ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে বিচার করার প্রবণতা এখন প্রবল। প্র

বাংলার বুকে প্রথমবার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বাস্তবে কি ব্যক্তিজীবনে, কি রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থায় ‘ধর্ম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য যে রকম প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার অনুকূলে যে রকম মজবুত গাঁথুনি তৈরি করা দরকার ছিল তার কোনোকিছুই পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, পাকিস্তানের পরাজয় মানে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিজয়। যে মানুষ ২৫ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত পাকিস্তানের ভৌগোলিক কাঠামোয় এবং রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিল, রাতারাতি তার মধ্যে আদর্শিক পরিবর্তন ঘটার কোনো স্বাভাবিক কারণ ছিল না। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে, ক্রমাগত উন্নত বা অগ্রগামী দর্শন চর্চার মধ্য দিয়ে।

 আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোন একটা সময় আদর্শ ভিত্তিক সংগঠন ছিল না।এটা ছিল মূলত বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের একটি বৃহত্তর জাতীয় প্লাটফরম। এই দলের পতাকাতলে যারা সমবেত হয়েছিলেন তারা সবাই এক মত, এক পথের ছিলেন না। এমন কি দলের নেতৃত্বের মধ্যেও চিন্তার পার্থক্য ছিল। আওয়ামী লীগের মধ্যে একাধিক ধারা সক্রিয় ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ধারাটি এক সময় প্রধান হয়ে উঠলেও তার বিরোধী একটি ধারা দুর্বল হলেও সক্রিয় ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িক চেতনা যেমন আওয়ামী লীগে ছিল, তেমনি ধর্ম নিয়ে দুর্বলতাও ছিল।




সবচেয়ে শক্তিশালী দল মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো, মাত্র ৭ বছর পার হতে না হতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় সেই মুসলিম লীগের কবর রচিত হলো। এ পরিসংখ্যান আমাদের অজানা নয় যে, এই অঞ্চলের মানুষই পাকিস্তানের পক্ষে একচেটিয়া ভোট দিয়েছিল। তো, এই যে মানুষের মন পরিবর্তন, একেবারে এদিক থেকে ওদিক যাওয়া – এর পেছনে ঠিক কি কি বিষয় কাজ করেছে তা কি আমাদের কোনো রাজনৈতিক চিন্তাবিদ বা সমাজ গবেষকের গবেষণায় উঠে এসেছে? এটা কি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সচেতনতাজাত, নাকি তার সঙ্গে আবেগ এবং হুজুগপ্রিয়তার মিশেলও ছিল? 

বাংলার সমাজ ব্যবস্থা যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ ও লালন করতে পারছে না,সম্প্রীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা যে আজ এক চরম অন্তর্জ্বালা নিয়ে বসবাস করছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে অতীতের দিকে চোখ দিয়েই। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বলে বিলাপসঙ্গীত গেয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়া যাবে না। সেটা গড়তে হলে ঐতিহাসিকভাবে যে ভুলভ্রান্তি আমরা করে এসেছি তা স্বীকার করে ফাঁকফোকড় মেরামত করে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।


বাংলাদেশে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন, তাদের কাছে ড. আহমদ শরীফের নাম অজানা থাকার কথা নয়। তিনি একজন মুক্তবুদ্ধির মানুষ ছিলেন। ধর্মের প্রতি যে তার আস্থা-বিশ্বাস ছিল না, সেটা তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই সবার সামনে প্রকাশ করেছিলেন। তাকে ‘নাস্তিক’ বলা হতো। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা, ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। কিন্তু তিনি তার চিন্তায় তার ছাত্রদেরও খুববেশি প্রভাবিত করতে পারেননি। ধর্ম বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসজাত সংস্কার-কুসংস্কার মানুষের মনে যতটা সহজে বাসা বাধে, ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার পরামর্শ ততটা মানুষকে আলোড়িত-আলোকিত করে না।


মানুষ সহজাতভাবেই যুক্তিবাদী বা যুক্তিপ্রিয় হয় না। যুক্তিবাদিতা একটি বিশেষ গুণ বা প্রবণতা যা চর্চার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। অন্ধ বিশ্বাস কিংবা যুক্তিহীনতা মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। অন্যদিকে কুসংস্কারমুক্ত ও যুক্তিবাদী মন মানুষকে বিনয় ও সৌজন্যতার ধারায় অগ্রসর হতে সহায়তা করে।


ড. আহমেদ শরীফ ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। পাঠ্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও ক্লাসে গল্পোচ্ছলে তিনি এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেন, যা শিক্ষার্থীদের মন ও মনন গঠনে ভূমিকা রাখত। একদিন তিনি আমাদের ক্লাসে এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বা হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের সূচনা কীভাবে ঘটল সেটা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, পরষ্পরকে জানা-বোঝার ঘাটতি থেকেই মূলত ভুল বোঝাবুঝির উৎপত্তি।


তিনি বলেছিলেন, “ইসলাম এদেশে এসেছে বাইরে থেকে। ইসলাম প্রচারের জন্য যারা এলেন তারা বহিরাগত, এখানকার মানুষের আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার তাদের অজানা। এখানে অনেকে মাথা মুড়ে এক গোছা চুল মাথার ওপর রেখে দিত, যেটা টিকি বলে পরিচিত। তো, বিদেশ থেকে আগত অন্য ধর্ম বিশ্বাসীরা ভাবলেন, ভুল করে হয়তো ওই কেশগুচ্ছ মাথায় থেকে গেছে, সেটা কেটে দিলে পুরো মস্তক মুন্ডিত হবে, দেখতে সুন্দর লাগবে। তারা টিকি কেটে দিল এবং তৈরি হলো বিড়ম্বনা-সন্দেহ-অবিশ্বাস।”


“আবার ইসলাম ধর্মের দাওয়াত নিয়ে যারা এলেন, তারা পশ্চিমমুখি হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে যেভাবে নামাজ আদায় করছিলেন, সে পদ্ধতিটা এখানকার অধিবাসীদের অজানা ছিল। এরা ভাবলেন, বিদেশি মেহমানরা হয়তো ডিগবাজি খেতে চান, কোনো কারণে পারছেন না। তাকে সহযোগিতা করার জন্য সেজদারত অবস্থায় উল্টে দিতে গিয়ে বেধে গেল গন্ডগোল। নামাজি তার নামাজ নষ্ট করার জন্য এখানকার অধিবাসীর ওপর রুষ্ট হলেন। তৈরি হলো সন্দেহ-অবিশ্বাস।”


না, ঠিক এই গল্পের মতো করেই হয়তো সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপিত হয়নি, তবে এটা থেকে শিক্ষণীয় বিষয়টা হলো এই যে, এক ধর্মের মানুষ যদি অন্য ধর্মের মানুষ সম্পর্কে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল থাকেন তাহলে পরস্পরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি কম হতে পারে। সব থেকে বড় কথা হলো, যে যে ধর্মবিশ্বাসী তাকে সেই ধর্ম পালনের অধিকার দিতে হবে। মুসলমান নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি করার অধিকার পাবে, হিন্দুও তার পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে অনায়াসে, অবাধে। অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।


এমন অবস্থা যখন বাধাগ্রস্ত হয়, এক পক্ষ যখন অন্য পক্ষের বিশ্বাস নিয়ে কৌতুক-তামাশা করে কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-উপহাস করে তখনই বিষয়টি আর সহনীয় থাকে না। গোলমাল বাধে, বেধে যায় দাঙ্গা-হাঙ্গামাও।


প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর আগের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। রোজার মাসে দুর্গাপূজা পড়ে যাওয়ায় কিছুটা নিষ্প্রাণ আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়কে দুর্গাপূজা পালন করতে হয়েছিল পরপর দুই বছর। সন্ধ্যার সময় তারাবির নামাজের কারণে কয়েক ঘণ্টা দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানাদি করতে হয়েছে একেবারেই নীরবে। মন্দিরে যদি ঢাক-ঢোল, কাঁসর ঘণ্টা না বাজে, সন্ধ্যারতি বা উলুধ্বনি না হয়, তাহলে তাকে দুর্গাপূজা বলা যায়? হিন্দুদের কাছে পূজা মানে উৎসব, পূজা মানে আনন্দ, পূজা মানে আনুষ্ঠানিকতা। শুধু পুরোহিতের শুষ্ক মন্ত্রোচ্চারণ বা ভক্তদের অঞ্জলি দেওয়ার মধ্য দিয়ে আড়ম্বরহীন পূজা উদযাপনে হিন্দুরা খুশি হতে পারে না। কিন্তু সম্প্রীতির নামে এখানে তো কার্যত পরপর দুই বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্ম পালনের অধিকার খর্ব করা হয়েছে।


দেশের টাকা পাচার হচ্ছে বাইরে এটা এখন বাংলাদেশে বহুল আলোচিত বিষয়। কিন্তু কারা দেশের বাইরে টাকা পাচার করে? তারা সকলেই কি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ? কিন্তু সাধারণভাবে কি প্রচার হচ্ছে? “হিন্দু প্রদেশের লোক এদেশে বসবাস করে, আয়-উপার্জন করে, আর সব করত কুড়ি পাচার করে দেয় ভারতে”। হিন্দুরা কেউ কেউ ভারতে টাকা পাচার করেন না, সেখানে অট্টালিকা নির্মাণ করেননি, তা কিন্তু নয়। আমজনতার প্রশ্ন, ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে টাকা পাচার করে, বাড়ি তৈরি বা ফ্ল্যাট ক্রয় যদি দোষের না হয়- তাহলে ভারতবর্ষের বেলাতে সেটা দোষের হয় কি করে? কনাডা, যুক্তরাষ্ট্র,মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, জাপান,আমেরিকা যেমন বিদেশ ভারতে কিন্তু আমাদের জন্য বিদেশেই। ঐ দেশেগুলো তে  মুসলিম সম্প্রদায় অর্থ পাচার বা বসবাস যদি কোন দোষের না হয়, তাহলে ভারতের বেলায় সেটা হবে কেন? ভারত ‘হিন্দু’ প্রধান রাষ্ট্র বলেই কি ভারতের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং বিদ্বেষ বেশি। অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার অভাব মানুষ হিসেবেই কি আমাদের ছোট করে দেয় না? এগুলো কি আমাদের ইগোতে আমাদের স্ট্যাটাসে বাধার কারণ হয়ে দাড়ায় না?  ধর্মীয় পরিচয়কে মহান চোখে দেখা লোক গুলো, যারা অন্য ধর্ম বিশ্বাসীদের মনে কষ্ট দেন, তারা কি সত্যিকারের মানুষ হতে পেরেছে?


রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করা হোক। মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য গুলোর মধ্যে এটা অন্যতম ছিল। কিন্তু আজও আমরা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। আর এই সংখ্যাধিক্য ও সংখ্যালঘুর নামে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ হবে বলে কোন আশার আলো দেখা যায় না। বরং দিন দিন এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।

লেখক:ব্লগার,রেজাউল হক।





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সিলেটি ভাষা ও সংস্কৃতি

নতুন সমাজ ব্যবস্থায় হাটছি আমরা

প্রসঙ্গ: ধর্মওয়ালা শাসক শোষক বনাম অভিজিৎ