প্রসঙ্গ:কিশোর গ্যাং
সমাজে প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা ধরনের অপরাধ। ঘটে যাওয়া এসব অপরাধ আর অনিয়মের অনেক কিছুই ঢাকা পড়ে অন্ধকারে। হারিয়ে যাওয়া সে সব অনিয়ম আর অপরাধের কথা অনেকে বলতে চেয়েও বলতে পারছেন না।
দিন দিন বড় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর অপরাধীদের বিভিন্ন গ্রুপ। বিভিন্ন নামে পরিচিত করছে তারা নিজেদেরকে। জড়িয়ে পড়েছে ছোট থেকে বড় ভয়াবহ সব অপরাধে। পরিবারের খামখেয়ালী আর শিক্ষাব্যবস্থার দুর্দশার কারণে বাবা-মা-ভাই-বোন কিংবা শিক্ষক কেউই টের পাচ্ছেন না আদরের সন্তান আজ কতটা আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠছে। মাদক সন্ত্রাস ছিনতাই চাঁদাবাজি দখলদারিত্বের পাশাপাশি ভারটে বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব কিশোর। ইফটিজিং সহ প্রায় সব ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে তাদের নাম। সুদি এসব নয় খুনখারাপিতে ও জড়িয়ে পড়ছে তাদের নাম।এখন শুধু ছেলে নই লেডি কিশোর গ্যাং ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। আর এখন এটি শুধু শহরভিত্তিক নয় গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে এমন ভয়াবহ কর্মকাণ্ড।
![]() |
ছবিঃ ইন্টারনেট |
শুরুতেই মনে করিয়ে দিতে চাই ৭ জুলাই ২০১৯ সালের ঘটে যাওয়া শুভ হত্যার কথা কিশোর গ্যাং এর দ্বারা ছুরি আঘাতে মারা যায় গাজীপুরের টঙ্গী থানার নবম শ্রেণীর ১৬ বছরের ছেলে শুভ আহমেদ। এমনি ভাবে হত্যা করা হয়েছিল ২০১৭ সালের আদনান কবিরকে । গ্যাংয়ের নৈপথ্য বিস্তার করতে কুন্দল চলছিল ডিসকো বয়েজ’ ‘বিগবস ও নাইন স্টার গ্রুপের মধ্যে। অবশেষে ডিসকো বয়েজ ও বিগবস গ্রুপের সদস্যরা নাইন স্টার গ্রুপের তালা চাবি রাজুকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করে ঘটনাস্থলে তাকে না পেয়ে আদনান কবির কে হত্যা করে। এ বছরের শুরুতেই হত্যা করা হয়েছে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ১৭ বয়সী কিশোর হাসান কে।
![]() |
ছবিঃ ইন্টারনেট |
বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেকটাই পাল্টে গেছে এখন মাদক আর অস্ত্র সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় কিশোর গ্যাং দ্বারা। ২০১৯ সালে ২২শে জুলাই আটক হয় ফাস্ট ফিটার বস নামের কিশোর গ্যাংয়ের ১৪ সদস্য যাদের বয়স ২০এর উর্ধে নয়। তারা মাদক ও অস্ত্র নিয়ে ধরা পড়ে। এবছর করোনা কালীন সময়ে জুন মাসে ডনসাগর ও মুন্না গ্রুপের আটক হয় ১৬জন।লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলমের দাবি, আটক কিশোরদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক সেবন, ইভ টিজিং, চাঁদাবাজির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা টিকটক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ করত।
চিন্তার বিষয় হলো, একটা সমাজে "গ্যাং" তৈরির পিছনে যে কয়টি ধারণা চালু আছে। তার ভিতর ''লেভেলিং থিওরি'' অন্যতম। কোন গ্যাংকে তাদের নামেই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো আমরা পরোক্ষভাবে তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সে যে তার নিজের নামে দেশ ব্যাপী পরিচিতি পাচ্ছে। এটাই 'গ্যাং' মেম্বারদের কাছে একটা বড় সাফল্য। এদেশের প্রেক্ষিতে সম্ভবত সবচেয়ে বড়ও বটে।
একজন কিশোরের মন-মস্তিষ্কে দলনেতা হয়ে উঠার উপলব্ধিটা আসে কোথা থেকে? খেলার মাঠের অভাব শিক্ষাব্যবস্থার প্রাচীন প্রথা এবং পরিবারের খামখেয়ালিতে কিশোর হয়ে উঠছেন গ্যাং লিডার। এই সবের আরেকটি কারণ ভিডিও গেমস এবং ফিল্ম। যা আমাদের কিশোরদের উপর প্রভাব বিস্তার করছে। সারাদিন অনলাইন টিক টক ভিডিও ফিল্ম আর গেমস এর মতো জীবন সাজানোর চেষ্টা করছে। অনেক পাওয়ার আর ক্ষমতা অর্জন করতে মরিয়া হয়ে উঠছে আজকের এই কিশোর।
আমার মতে আরো একটি বড় কারণ আছে বলে মনে হয় একটা গ্রুপ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য গডফাদার এর দরকার হয়। বাংলায় একটা কথা আছে 'বাপের ও বাপ থাকে'। একতার জের ধরে বলতে চাই এই কিশোর সমাজের উপর মহলে আছে রাজনীতির হাত। বর্তমানে গ্রামের মেম্বার থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত সবারই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ আর সেসব গ্রুপের প্রধান সদস্য এই কিশোরেরা। এইসব রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায় হয়ে ওঠে এই কিশোর গ্যাং। আমার দেখা মতে আমাদের সিলেট শহরের প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ যেমন নাদেল গ্রুপ, ময়নুল গ্রুপ, কাশমির গ্রপ, কাউন্সিলর কামরান গ্রুপ ইত্যাদি। তাছাড়া ও ২জুন ২০২১ সিলেট নগরীতে আটক হয় ১৬ কিশোর।একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে শুধুমাত্র ঢাকা বিভাগে ৭৮ টি কিশোর গ্যাং রয়েছেন। যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আছেন অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি।(রাজধানীতে কিশোর গ্যাং এর ৭৮ গ্রুপ সক্রিয়: নেপথ্যে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ)
পুলিশের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক শেল্টারদাতা বা পৃষ্ঠপোষক হিসাবে অর্ধশত ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। কেউ কেউ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে সুবিধার জন্য সরকারি দলের সাইনবোর্ডসর্বস্ব পদ-পদবিও নিয়েছেন। তালিকায় নাম আছে এমন নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিল্পাঞ্চল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি জিল্লুর রহমান ওরফে জীবন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তালুকদার সারোয়ার হোসেন, মোহাম্মদপুর এলাকার চন্দ্রিমা হাউজিং ও সিলিকন হাউজিংয়ের মালিক ছারোয়ার ও নাজিব আমজাদ এবং গ্রামবাংলা হাউজিংয়ের মালিক কবির, ড্রিমল্যান্ড হাউজিংয়ের মালিক সাদিকুর রহমান ওরফে বকুল, শেরেবাংলা নগর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদ। আদাবর এলাকার ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কাশেম, ১০০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি পাপ্পু।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজকের কিশোর যদি এমন অপরাধ আর দন্ডের সাথে জড়িয়ে যায় অদূর ভবিষ্যতে সত্যিকারর্থে, আগামী প্রজন্মের একজন স্বামী, পিতা ও অভিভাবক হিসেবে তার ব্যর্থতাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি।আমরা যখন এদের নিয়ে সমালোচনা করি পুরো দোষটা এদের উপর চাপিয়ে দেই। অথচ বেশিরভাগ দায় অগ্রজ প্রজন্ম হিসেবে আমাদেরই। এদের প্রতি আমাদের সহানূভুতিশীল হওয়া উচিত। এরা একটা শক্তি। এদের বেশিরভাগেরই কাজের স্পৃহা অনেক বেশি। এই শক্তিকে গৎবাঁধা নিয়মে আটকাতে চেষ্টা না করে, কিভাবে উপকারী পথে প্রবাহিত করা যায় সেটা ভেবেই কাজ করা উচিত৷ প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টি অনেকটা বড় ভূমিকা পালন করবে বলে আশাবাদী।
লেখক:ব্লগার,রেজাউল হক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন